সমন্বিত সাত ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা ছিল শুক্রবার। রাজধানীর ৬৫ থেকে ৭০টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় এই পরীক্ষা। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) বলেছিল, সামাজিক দূরত্ব মেনে সারিবদ্ধভাবে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। প্রবেশপত্রেও বলা ছিল মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে হুড়োহুড়ি করে ঢুকতে দেওয়া হবে না। প্রার্থীদের দূরত্ব বজায় রেখে সারিবদ্ধভাবে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। এ ছাড়া বড় বেঞ্চে দুই পাশে দুজন ও ছোট বেঞ্চে একজনকে বসতে দেওয়া হবে। সর্বোপরি বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয়নি বেশিরভাগ কেন্দ্রে।
শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে থেকে কেন্দ্রের সামনে জড়ো হতে থাকে পরীক্ষার্থীরা। অনেকের সঙ্গে ছিল অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা। কেন্দ্রে প্রবেশের সময় ছিল কোনো স্বাস্থ্যবিধি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা টানেল মেশিনের প্রয়োগও চোখে
পড়েনি। মুখে মাস্ক থাকলেও শারীরিক দূরত্বের বালাই ছিল না। হুড়োহুড়ি করে ঢুকেছে। অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। আবার পরীক্ষা শেষে বের হওয়ার সময় ছিল দ্বিগুণ হুড়োহুড়ি। তখন অনেককেই মাস্ক খুলে হাত ও পকেটে রাখতে দেখা গেছে। অনেকে ঢাকার দূর অঞ্চল থেকে প্রাইভেটকার ভাড়া করে এসছে সদলবলে। আবার গেছেও একইভাবে। মাস্ক নিয়ে ছিল সাধারণ মানুষের মতো পরীক্ষার্থীদেরও নানা অজুহাত। মুখ ঘেমে যাওয়া, শ^াস-প্রশ^াসে কষ্ট হওয়া, একটানা মুখে না রাখতে পারা, দরকার হলে পারবেÑ এমন নানা যুক্তি দেখায় তারা। তবে পরীক্ষা কেন্দ্রে সংশ্লিষ্টদের মাস্ক পরিধান করতে দেখা গেছে।
বাইরের দেশে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো দেশে তৃতীয় ঢেউ চলছে। ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন করে নিয়মের কড়াকড়ি অব্যাহত আছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশেও মহামারি করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। আগামী মাস থেকেই হয়তো সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই সতর্ক করছেন। দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দ্বিতীয় দফায় আরও ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে করোনাÑ এমন শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা। তবে জনগণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সড়ক, বাজার, বন্দর কোথাও নেই স্বস্তিতে থাকার মতো স্বাস্থ্যবিধি। করোনায় সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক মাস্ক পরা নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা বাহানা। করোনা নিয়ে আতঙ্ক কমে যাওয়ায় থোরাই কেয়ার করছেন অনেকে।
বাংলাদেশেও গেল সপ্তাহান্তে নতুন করে বেড়েছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এ অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি ব্যবস্থাও কঠোর হচ্ছে। তবে মাস্ক নিয়ে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও মানা হচ্ছে না অনেক জায়গায়। সরকারি অফিস প্রতিষ্ঠান ও অনেক স্থাপনা কেন্দ্রে নেই এর শতভাগ ব্যবহার। আর রাস্তা কিংবা রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান থেকে ফুটপাথ সবখানে একই অবস্থা। বিমানবন্দরে নামলেই ফের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বললেও শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে সেখানেও।
তবে রাজধানীতে কেউ মাস্ক না পরলে জরিমানা করা হচ্ছে। সপ্তাহখানেক ধরে চলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। এ ছাড়াও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রমও চলছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় চলা অভিযানে দেখা গেছে অনেকেই মাস্ক পরছে না। কারও বাসা থেকে মাস্ক আনতে মনে নেই, কারও তা পরলে দম বন্ধ লাগে। আবার কেউ কেউ মাস্ক নিয়ে বের হলেও ‘পড়ে গেছে’ পথেÑ এমনই নানা অজুহাত বহু মানুষের। কারও বা ব্যাগে ও পকেটে আছে কারও মাস্ক উড়ে গেছে এমন কথাও শোনাচ্ছে তারা। জেল-জরিমানায় সীমাবদ্ধ না থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের হাতে বিনামূল্যের মাস্কও তুলে দিচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মাস্ক পরতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। গণপরিবহনের চালক ও যাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারে সচেতন করা হচ্ছে। অসচ্ছল জনসাধারণের মধ্যে মাস্ক বিতরণও করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দÐবিধি এবং সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ প্রয়োগ করে জরিমানাও করা হচ্ছে। দেশজুড়েই এই অভিযান আরও জোরদার করার কথা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে গণপরিবহনের অবস্থা যাচ্ছেতাই। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিন থেকেই গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া বাদ দিয়ে আগের মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত রাখা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না।
চালক, শ্রমিক, যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার ‘উপায় নেই’ তাদের। বিশেষ করে অতিরিক্ত যাত্রী না তোলার বিষয়টি কড়াকড়িভাবে পালনের নির্দেশ থাকলেও যাত্রী-শ্রমিক কেউ তা মানছে না। রোজই বিশেষ করে সকাল ও সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাসে গাদাগাদি করে চড়ছে অসংখ্য কর্মজীবী। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও অনেকে তা মানছে না। হাঁচি-কাশিতে ব্যবহার করা হচ্ছে না রুমাল কিংবা টিস্যু। আর করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে সীমিত আকারে ও অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন চলাচলের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। সেদিন থেকেই সব আসনে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও আসনের অতিরিক্ত যাত্রী না নিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় আবারও নির্দেশ দেয়। কিন্তু গত দুই মাসের বেশি সময়েও বেসরকারি সাত রুটে চলা সাতটি বেসরকারি লোকাল কমিউটার ট্রেনকে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যাচ্ছে না। আসনের অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ও বসে একে অন্যের শরীরের সঙ্গে ঘেঁষে গাদাগাদি করে যাওয়া-আসা করছে। ফলে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। আর ছুটির দিনে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিউমার্কেট, গুলিস্তান, গাউছিয়া মার্কেটসহ বিভিন্ন বিতানে ভিড় দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না মার্কেটের ভেতরে। কেনাকাটা করতে আসা বেশিরভাগের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। অনেক মার্কেটের প্রবেশ মুখেও হাত ধোয়ার কোনো ব্যবস্থা ও জীবাণুনাশক স্প্রের ব্যবস্থা নেই। তবে মগবাজার পান্থপথসহ কয়েকটি মার্কেটের সামনে মাস্ক পরতে মাইক দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে করোনা মহামারিতে দেশের হোটেলের স্বাস্থ্যবিধি প্রটোকল সন্তোষজনক নয় বলে মনে করে ৪০ শতাংশ মানুষ। বৃহস্পতিবার এক অনলাইন জরিপের ফল প্রকাশ করে এ তথ্য জানিয়েছে ভ্রমণ ও পর্যটন বিষয়ক প্রকাশনাÑ দ্য বাংলাদেশ মনিটর। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ মনে করে হোটেলের অবস্থা যথেষ্ট ভালো এবং ২২ শতাংশ এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন নয় বলে জানায়।
জরিপে দেখা যায়, দেশের ভেতর ভ্রমণকালে ৭১ শতাংশ মানুষ এখন হোটেলে থাকাকেই পছন্দ করে। তবে করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত হোটেলে থাকার কথা ভাবছে না ৪০ শতাংশ মানুষ। শীত মৌসুম আসতে না আসতেই বক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আশপাশের প্রায় সব হোটেল মোটেল বুকিং হয়ে গেছে। সিলেট চট্টগ্রাম বান্দরবানসহ বিভিন্ন পর্যটন অঞ্চলে ছুটির দিনে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। দল বেঁধে ঢাকা থেকে ঘুরতে যাচ্ছে মানুষ। প্রশাসন চেষ্টা করেও শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করতে পারছে না।
মাস্ক পরিধানে জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কার্যকর করতে হবে। কড়াকড়ি আরোপ দেশের সবখানে নিশ্চিত করতে হবে। কেননা আপাতত টিকার বিকল্প হচ্ছে মাস্ক। ভ্যাকসিন আসুক আর না আসুক, আমাদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। সারা দেশেই জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, ইদানীং করোনা আবার বেড়ে গেছে। জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। গা ছাড়া একটা ভাব চলে এসেছে। এটা কোনোভাবেই হওয়া যাবে না। মাস্ক পরতে জনগণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ৮০ শতাংশ মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে পারলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানো যাবে। সামনে শীতে ফের করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন এবিএম আবদুল্লাহ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সানিয়া তাহমিনা বলেন, করোনার সংক্রমণ কিন্তু গত বছর শুরু হয়েছিল শীতকালেই, ডিসেম্বর মাসে। তখন দেখা গেছে, শীতপ্রধান দেশগুলোয় দ্রæত ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে আশঙ্কা করা তো স্বাভাবিক। কিন্তু শীতকালের সঙ্গে করোনাভাইরাসের সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপউপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার।
সময়ের আলোকে তিনি বলেন, জনগণকে নিজের প্রয়োজনেই মাস্ক পরতে হবে। এখন সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাকসিনের পরও মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। মাস্ক পরার প্রতি সচেতনতা মানুষের মধ্যে বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আসলে আমাদের সমাজে করোনা ও মাস্ক নিয়ে যে নেতিবাচক চিন্তা তা স্বাভাবিক। কারণ শুধু আমরা না, ভিনদেশিরাও এসবে অভ্যস্ত না। দেশজুড়ে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আরও প্রচার বাড়াতে হবে। সচেতনতা কার্যক্রমে ঢিলেমি করলে জনগণ ধরে নেবে করোনা বোধ হয় চলে গেছে।