অস্ত্র আইনের মামলায় নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমনকে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে গুলি উদ্ধারের অভিযোগে তাদের আরও ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সোমবার দুপুরে ঢাকার ১নং স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন। বিচারক তার আদেশে পৃথক দুই ধারার কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে উল্লেখ করেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অস্ত্র মামলায় আলোচিত এই দম্পতির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হলো। আলোচিত এই দম্পতির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে অস্ত্র আইনের এ মামলাই সবার আগে রায় ঘোষণা করা হলো। রায় ঘোষণার জন্য এদিন তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় পড়ার সময় পাপিয়া নীরব ছিলেন। বিচারক যখন তাদের কারাদণ্ডের আদেশ দেন তখন পাপিয়া কাঁদতে থাকেন। রায় ঘোষণার পর সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এরপর পুলিশ সদস্যরা তাদের কারাগারে নিয়ে যায়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, আসামি শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ও তার স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওতপ্রোতভাবে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তবে তাদের সজ্জন কর্মী বা নেতা বলা যায় না। আসামিরা রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হলেও তাদের বাসায় এত বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা (৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা) রাখার কোনো যৌক্তিক বা বৈধ কাগজ থাকতে পারে না। সুতরাং তাদের মতো এ ধরনের তথাকথিত রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে শুধু নিজেদের প্রাপ্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা দেশ ও জাতির জন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজ করতে পারে না। তাই এ রায় রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বার্তা। তিনি আরও বলেন, দেশ ও জাতির কল্যাণের চেয়ে যারা নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। এ ধরনের রাজনীতিবিদ বা নেত্রী যেকোনো ধরনের অন্যায় কাজ করার জন্য অবৈধ অস্ত্র সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করে। সুতরাং আসামিরা এ ধরনের অবৈধ অস্ত্র বাসায় ডায়নিং রুমের খাটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল, যেকোনো ধরনের অন্যায় কাজে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে। যদিও অস্ত্র আইনের ১৯(এ) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৯(এফ) ধারায় ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবুও আসামিরা একই পরিবারের হওয়ায় আদালত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে ১৯(এ) ধারায় ২০ বছর এবং ১৯(এফ) ধারায় ৭ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন।
রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, তারা দুজনেই রাজনীতি করত, রাজনীতিবিদ। তাদের বাড়ি থেকে অনৈতিকভাবে আয় করা এতগুলো টাকা এবং অস্ত্র পাওয়া গেছে। যেহেতু তারা দুজনে একই পরিবারের, সেজন্য তাদের যাবজ্জীবনের পরিবর্তে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এএফএম গোলাম ফাত্তাহ বলেন, মামলাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টোটালি সাজানো ও ত্রুটিপূর্ণ। এক দিনের জন্যও তাদের সাজা হতে পারে না। সেখানে ২০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। তাই এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করবে। এর আগে গত ২৯ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১-এর এসআই মো. আরিফুজ্জামান এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ছয় কার্যদিবসে মোট ১২ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।
জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাল টাকা বহন ও অবৈধ টাকা পাচারের অভিযোগে শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ও তার স্বামীসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে রাজধানীর ইন্দিরা রোডে পাপিয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়। এ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে দল থেকে পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ওই ঘটনায় পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অস্ত্র মামলা ছাড়া বাকি মামলাগুলো হলো শেরেবাংলা নগর থানার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা, গুলশান থানায় মানি লন্ডারিংয়ের মামলা, বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে (জাল টাকার) মামলা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলা। এই মামলাগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন।